এলোমেলো বর্ণমালার শিরোনাম দিয়ে সাকিরা পারভীন লিখেছেন ছড়ানো ছিটানো মনের কথা। বাংলা অণুকবিতার ভুবনে ‘ছড়ানো ছিটানো মন’ নতুন সম্ভাবনা হতে পারে। তার বলার মধ্যে, ভাবনার মধ্যে সরস ভঙ্গি আছে।
এলোমেলো বর্ণমালার শিরোনাম দিয়ে সাকিরা পারভীন লিখেছেন ছড়ানো ছিটানো মনের কথা। বাংলা অণুকবিতার ভুবনে ‘ছড়ানো ছিটানো মন’ নতুন সম্ভাবনা হতে পারে। তার বলার মধ্যে, ভাবনার মধ্যে সরস ভঙ্গি আছে। এপিগ্রাম বা তীক্ষন শ্লেষোক্তির একটা সহজাত ভঙ্গি তিনি আনায়াসে আয়ত্ত করেছেন বলে প্রতীয়মান হয়।
নেহাতই প্রেমের কথা বলেন তিনি, কিন্তু সেখানেও আছে সরস-সরল তীক্ষনতা। ধরা যাক এই কবিতাটির কথাই
‘ওয়ান টু থ্রি সব ক্লাস পাশ করেছি
তুমি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াও
রোজ রোজ ফেল করি’ (আ)
রোজ রোজ ফেল করানোর এই পাঠের মধ্যে বেদনা তো বিদ্যমান, শ্লেষও কি নেই! এই শ্লেষ কখনো কখনো নিজেকেই ছুঁয়ে যায়। আরেকটি কবিতায় তিনি বলছেন
‘অলথ্রু ফার্স্ট ক্লাস
ভালোবাসায় ৩২
বিরহে ৩৩।’ (ঔ)
আগাগোড়া প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়ে ভালোবাসায় এক নম্বরের জন্যে পাশ করেন না তিনি, বিরহে কোনোভাবে পাশ করে যান। তবে জীবনের অংকটা কি মেলে ঠিকঠাক! সাকিরার ‘ছড়ানো ছিটানো মন’ প্রেম ও বিরহের সিলেবাসে আমাদের অনেকেরই কমন পাঠ্য হয়ে যায়। তবে নেহাতই প্রেম-বিরহের নয়, সাকিরা তার তীক্ষ্নধীসম্পন্ন এইসব কবিতায় বিশ্বসংসার, রাজনীতি, মানবিক বৈকল্যের অনেক কথাই বয়ান করেন।
‘রিক্টার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা ৮.৪
তুমি চাপা পড়েছ
আমি বেঁচে গেলাম
ফ্লাটের কিস্তি দিতে হবে না।’ (ঊ)
পাঠক, একবার এই সরস ভঙ্গির ভয়াবহ চিত্রটি ভেবে দেখুন। ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পের পর একজন চাপা পড়লো, আরেকজন বেঁচে গেলো, তার বেঁচে থাকার আনন্দ কি ফ্লাটের কিস্তির জোয়াল না-টানারই আনন্দ! বিপর্যয়ের পর লাভ-ক্ষতির এ হিসাবে আজকের ফ্লাট-উন্মাদনাকে হয়তো শ্লেষের চোখেই দেখে।
আজকের এই সময়ে এসে সবকিছুতেই মানুষের লাভ-ক্ষতির খতিয়ান খুঁজে দেখার প্রবণতা কবিকে বিদ্ধ করে নিশ্চয়ই, অন্তত তার কাব্যপাঠ আমাদেরকে তেমনই ভাবায়
‘সমস্ত ব্যবসার অবসান হয়েছে
লোকসানে পড়ে মরে আছে মানুষ
অমানুষ হলে লাভবান হওয়া যেত
লাভ গুণতে গুণতে বেঁচে যেতাম’ (স্ত)
কিন্তু এতো লাভ-লোকসানের হিসাবের পরও মানুষ মূলত একা। তার অন্তর অন্ধকারের মতোই পরিজনহীন, ভয়াবহ ফাঁকা
‘তোমরা যে যাই বল
অন্ধকারের কোনো সহদর নেই
তোমরা যে যাই বল
অন্তরের কোনো সহকর্মী নেই।’ (ঢ়)
কেবল অন্তর আর অন্ধকারই তার আরাধ্য নয়। কবি সাকিরা পারভীন বরং ভীষণভাবেই রাষ্ট্র আর রাষ্ট্রতন্ত্র নিয়ে ভাবেন। গণতন্ত্রের সুলভ-নিয়মিত ব্যবহারকে তিনি তুলে আনেন বিচিত্র অথচ খুবই চেনা এক চিত্রকল্পে
‘থুতু দিয়ে পাতা উলটানো প্রাইভেট টিউটরকে
ঘৃণা করতাম।
এখন থুথু দিয়ে তোমাকে উলটাই
গণতন্ত্র...।’ (ঠ)
অন্যদিকে সামরিকতন্ত্রের চিত্রায়ণটিও ছোট্ট ঘাসের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেন তিনি। যে ঘাসের বুকে শিশিরের কণা খেলেছিলো সে ঘাসের বুকেই মিলিটারির বুটজুতা ভয়াবহ বৈকল্য ও বিকারের ইঙ্গিত দেয়Ñ
‘ঘাসের সঙ্গে কাল খেলেছিল
শিশিরের কণা
ঘাসের সঙ্গে আজ খেলা করে
মিলিটারি সেনা।’ (ফ)
মাত্র চারলাইনে সামরিক শাসনের দলিত-মথিত করার চিত্রটি উঠে আসে জীবন্ত হয়ে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিত আমাদের সমকালের বাংলা কবিতার পরিসরে হয়তো তেমন তীক্ষন আর সরস করে আসে না যেমন করে সাকিরা তুলে ধরেছেন
‘উত্তর কোরিয়ায় নিষেধাজ্ঞা
পরমাণু বোমা
দক্ষিণ কোরিয়ার কবি
লেখক অজানা
তামিল বিদ্রোহী আছে
ফুলে ফুলে হরমোন চাষ
শান্তির পায়রা ওড়ায়
ভারতের নাটক সন্ত্রাস!’ (প্ত)
শান্তি শান্তি করে যে ঘোরেল বিশ্ব-নাটকের মহড়া চলছে প্রতিদিন তার প্রহসনটি সাকিরা মাত্র কয়েকটি শব্দ জুড়ে এঁকে ফেলেন কুশলী শিল্পীর দক্ষতায়। এমনি আরেকটি শিল্প সফল এবং সচেতন উচ্চারণ পাই ‘গ’ শিরোনামের কবিতায়
‘প্রথম পাতা থেকে না লিখে
উলটো দিক থেকে
লিখতে শুরু করেছি
অথচ কত বছর হলো
তুলে রেখেছিলাম
প্রথম পাতা থেকে লেখার আকাক্সক্ষায়
সেকুলারিজম...।’ (গ)
পাতা উলটানোর এই সমীকরণ সাকিরার কবিতার দেহ ও মনে ভিন্ন আমেজ ও মাত্রা দেয়।
এমনকি কবিতার শিরোনামেও সাকিরা অভিনব, নতুন ও চিন্তাশীল। বাংলা স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ, যুক্তবর্ণগুলোকে নিজের মতো উল্টেপাল্টে ব্যবহার করে পুরো বইয়ে তিনি একটা ভিন্ন আবহ নিয়ে আসেন।
‘ছড়ানো ছিটানো মন’ অণুকবিতা বিশ্বে একটি অভিনব সংযোজন হয়ে থাকুক।
এলোমেলো বর্ণমালার শিরোনাম দিয়ে সাকিরা পারভীন লিখেছেন ছড়ানো ছিটানো মনের কথা। বাংলা অণুকবিতার ভুবনে ‘ছড়ানো ছিটানো মন’ নতুন সম্ভাবনা হতে পারে। তার বলার মধ্যে, ভাবনার মধ্যে সরস ভঙ্গি আছে।
By সাকিরা পারভীন
Category: কবিতা
এলোমেলো বর্ণমালার শিরোনাম দিয়ে সাকিরা পারভীন লিখেছেন ছড়ানো ছিটানো মনের কথা। বাংলা অণুকবিতার ভুবনে ‘ছড়ানো ছিটানো মন’ নতুন সম্ভাবনা হতে পারে। তার বলার মধ্যে, ভাবনার মধ্যে সরস ভঙ্গি আছে। এপিগ্রাম বা তীক্ষন শ্লেষোক্তির একটা সহজাত ভঙ্গি তিনি আনায়াসে আয়ত্ত করেছেন বলে প্রতীয়মান হয়।
নেহাতই প্রেমের কথা বলেন তিনি, কিন্তু সেখানেও আছে সরস-সরল তীক্ষনতা। ধরা যাক এই কবিতাটির কথাই
‘ওয়ান টু থ্রি সব ক্লাস পাশ করেছি
তুমি কোন বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াও
রোজ রোজ ফেল করি’ (আ)
রোজ রোজ ফেল করানোর এই পাঠের মধ্যে বেদনা তো বিদ্যমান, শ্লেষও কি নেই! এই শ্লেষ কখনো কখনো নিজেকেই ছুঁয়ে যায়। আরেকটি কবিতায় তিনি বলছেন
‘অলথ্রু ফার্স্ট ক্লাস
ভালোবাসায় ৩২
বিরহে ৩৩।’ (ঔ)
আগাগোড়া প্রথম শ্রেণিতে উত্তীর্ণ হয়ে ভালোবাসায় এক নম্বরের জন্যে পাশ করেন না তিনি, বিরহে কোনোভাবে পাশ করে যান। তবে জীবনের অংকটা কি মেলে ঠিকঠাক! সাকিরার ‘ছড়ানো ছিটানো মন’ প্রেম ও বিরহের সিলেবাসে আমাদের অনেকেরই কমন পাঠ্য হয়ে যায়। তবে নেহাতই প্রেম-বিরহের নয়, সাকিরা তার তীক্ষ্নধীসম্পন্ন এইসব কবিতায় বিশ্বসংসার, রাজনীতি, মানবিক বৈকল্যের অনেক কথাই বয়ান করেন।
‘রিক্টার স্কেলে ভূমিকম্পের মাত্রা ৮.৪
তুমি চাপা পড়েছ
আমি বেঁচে গেলাম
ফ্লাটের কিস্তি দিতে হবে না।’ (ঊ)
পাঠক, একবার এই সরস ভঙ্গির ভয়াবহ চিত্রটি ভেবে দেখুন। ভয়ঙ্কর ভূমিকম্পের পর একজন চাপা পড়লো, আরেকজন বেঁচে গেলো, তার বেঁচে থাকার আনন্দ কি ফ্লাটের কিস্তির জোয়াল না-টানারই আনন্দ! বিপর্যয়ের পর লাভ-ক্ষতির এ হিসাবে আজকের ফ্লাট-উন্মাদনাকে হয়তো শ্লেষের চোখেই দেখে।
আজকের এই সময়ে এসে সবকিছুতেই মানুষের লাভ-ক্ষতির খতিয়ান খুঁজে দেখার প্রবণতা কবিকে বিদ্ধ করে নিশ্চয়ই, অন্তত তার কাব্যপাঠ আমাদেরকে তেমনই ভাবায়
‘সমস্ত ব্যবসার অবসান হয়েছে
লোকসানে পড়ে মরে আছে মানুষ
অমানুষ হলে লাভবান হওয়া যেত
লাভ গুণতে গুণতে বেঁচে যেতাম’ (স্ত)
কিন্তু এতো লাভ-লোকসানের হিসাবের পরও মানুষ মূলত একা। তার অন্তর অন্ধকারের মতোই পরিজনহীন, ভয়াবহ ফাঁকা
‘তোমরা যে যাই বল
অন্ধকারের কোনো সহদর নেই
তোমরা যে যাই বল
অন্তরের কোনো সহকর্মী নেই।’ (ঢ়)
কেবল অন্তর আর অন্ধকারই তার আরাধ্য নয়। কবি সাকিরা পারভীন বরং ভীষণভাবেই রাষ্ট্র আর রাষ্ট্রতন্ত্র নিয়ে ভাবেন। গণতন্ত্রের সুলভ-নিয়মিত ব্যবহারকে তিনি তুলে আনেন বিচিত্র অথচ খুবই চেনা এক চিত্রকল্পে
‘থুতু দিয়ে পাতা উলটানো প্রাইভেট টিউটরকে
ঘৃণা করতাম।
এখন থুথু দিয়ে তোমাকে উলটাই
গণতন্ত্র...।’ (ঠ)
অন্যদিকে সামরিকতন্ত্রের চিত্রায়ণটিও ছোট্ট ঘাসের সঙ্গে মিলিয়ে দেখেন তিনি। যে ঘাসের বুকে শিশিরের কণা খেলেছিলো সে ঘাসের বুকেই মিলিটারির বুটজুতা ভয়াবহ বৈকল্য ও বিকারের ইঙ্গিত দেয়Ñ
‘ঘাসের সঙ্গে কাল খেলেছিল
শিশিরের কণা
ঘাসের সঙ্গে আজ খেলা করে
মিলিটারি সেনা।’ (ফ)
মাত্র চারলাইনে সামরিক শাসনের দলিত-মথিত করার চিত্রটি উঠে আসে জীবন্ত হয়ে। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক পরিপ্রেক্ষিত আমাদের সমকালের বাংলা কবিতার পরিসরে হয়তো তেমন তীক্ষন আর সরস করে আসে না যেমন করে সাকিরা তুলে ধরেছেন
‘উত্তর কোরিয়ায় নিষেধাজ্ঞা
পরমাণু বোমা
দক্ষিণ কোরিয়ার কবি
লেখক অজানা
তামিল বিদ্রোহী আছে
ফুলে ফুলে হরমোন চাষ
শান্তির পায়রা ওড়ায়
ভারতের নাটক সন্ত্রাস!’ (প্ত)
শান্তি শান্তি করে যে ঘোরেল বিশ্ব-নাটকের মহড়া চলছে প্রতিদিন তার প্রহসনটি সাকিরা মাত্র কয়েকটি শব্দ জুড়ে এঁকে ফেলেন কুশলী শিল্পীর দক্ষতায়। এমনি আরেকটি শিল্প সফল এবং সচেতন উচ্চারণ পাই ‘গ’ শিরোনামের কবিতায়
‘প্রথম পাতা থেকে না লিখে
উলটো দিক থেকে
লিখতে শুরু করেছি
অথচ কত বছর হলো
তুলে রেখেছিলাম
প্রথম পাতা থেকে লেখার আকাক্সক্ষায়
সেকুলারিজম...।’ (গ)
পাতা উলটানোর এই সমীকরণ সাকিরার কবিতার দেহ ও মনে ভিন্ন আমেজ ও মাত্রা দেয়।
এমনকি কবিতার শিরোনামেও সাকিরা অভিনব, নতুন ও চিন্তাশীল। বাংলা স্বরবর্ণ, ব্যঞ্জনবর্ণ, যুক্তবর্ণগুলোকে নিজের মতো উল্টেপাল্টে ব্যবহার করে পুরো বইয়ে তিনি একটা ভিন্ন আবহ নিয়ে আসেন।
‘ছড়ানো ছিটানো মন’ অণুকবিতা বিশ্বে একটি অভিনব সংযোজন হয়ে থাকুক।